বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

পথ

-কল্যাণী রমা

এমন ভাবিনি কোনদিন যে কোন পথের গল্প লিখব, কোনো বেড়ানোর গল্প লিখব সত্যি, সত্যি। একটু ঘরকুনো আমি। বেড়াতে যাওয়ার নাম শুনলেই অনেকের মত খুব আনন্দে নেচে ওঠে না প্রাণ। কেবলই নানা কারণ দেখিয়ে যতদূর সম্ভব বের হওয়াটাকে আটকানোর চেষ্টা করে চলি। এবারও দেখিয়ে চলেছিলাম একের পর এক নানা অজুহাত।


দু’একদিন আগে লাগিয়েছি অনেক স্বপ্নের লতা বেগুনি উইস্টেরিয়া ‘আন্ট ডী’। প্রথম কয়েকদিন তার গোড়ায় জল দেওয়া এবং তার খোঁজ-খবর নেওয়াটা সত্যিই খুব জরুরী। সাত বছর অনেক যত্ন করতে পারলে তবে উইস্কনসিনের বরফ তুচ্ছ ক’রে প্রথম ফুল ফোটে এই গাছে। আর আমার মত গাছ পাগল কেউ তখন সেই ফুল ফুটে ওঠা দ্যাখে চোখ জুলজুল ক’রে। ঠিক ওভাবেই তো নিজ সন্তানের প্রথম হাঁটি হাঁটি পা-ও দেখে - মানুষ!

এই উইস্কনসিনের ঠান্ডায় কোনমতে ৩০টি রোজবুশ হয়েছে আমার। ৩ সপ্তাহ না থাকলে কি হবে তাদের? বুনো খরগোশ খেয়ে গিয়েছিলো যে আঙ্গুরলতার সবটুকু তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এতটাই বড় হয়েছে যে একটি মাচার দরকার।

দু’বছর আগে যে ‘গোল্ডেন ডেলিশাস’ আপেল গাছটি লাগিয়েছিলাম, তাতে এই প্রথম ফল ধরেছে। যখন থাকব না তখনই তো তা পাকবে। কেমন হ’বে তার স্বাদ? পাখিরা জানবে! আর কি-ই বা হ’বে গ্রীষ্মের অতিথি  ‘হামিং বার্ড’-দের? ওদের ফীডার ঘনঘন পরিষ্কার ক’রে লাল নেকটারে ভরে দিতে হয়। বহুবার দেখেছি ফীডারে পিঁপড়ে দেখে ওদের ঠোঁট ঘুরিয়ে চলে যেতে। অনেক খুঁজেপেতে জোগাড় করেছি এক ঝুমকোলতা। প্রাণ ভরে ছেলেবেলার গন্ধ খুঁজে পাব ব’লে, দেশকে খুঁজে পাব বলে। তাতেও দেখছি কলি এসেছে। এদিকে এই প্রথম আমার করা দেশী লাউ ও কুমড়ো গাছে কড়া এসেছে। ৩ সপ্তাহে যদি তারা সত্যি সত্যি বড় হ’য়ে খাওয়ার মত হ’য়ে যায়! কিন্তু জল দেবে কে?

এখনও ভালোই বাগান করা যাচ্ছে। অথচ ফিরে এসে যদি দেখি উইস্কনসিনের লম্বা শীতকাল এসে গেছে! বরফ দেখতে দেখতে যদি অপেক্ষা আবার শুরু হ’য়ে যায় একটু সবুজ ঘাসের, সারা শীতকালের? প্রায় বুঝি আট-নয় মাস বরফের পেটে ঘুমিয়ে সবুজ জীবন জন্মায় এই পোড়া দেশে!

ওদিকে সব সেরা পিছুটান প্রাণের কুকুর টংসা আর সিম্বা। আমাদের সাথে সেই কবে দমদম থেকে প্লেনে চেপে শিকাগো এসেছিলো ওরা। কিন্তু এখন ওদের রেখে যেতে হ’বে কেনেলে? সদা ভয় এই বুঝি কিছু হ’য়। গতবার বিচ্ছু কুকুর টংসা নাকি ক্যাম্প কে-নাইন-এর ছয় ফুট উঁচু পাঁচিল টপকে পালানোর ফন্দি করেছিলো!

যাহোক বেড়ানোর পরিকল্পনার হর্তাকর্তা লাল নাছোড়বান্দা। প্রায় সাত হাজার মাইল নাকি সে একাই গাড়ি চালাবে। কে জানে আঠারো চাকার সেমাই-ট্রাক চালানোর চাকরি-ই খুঁজছে নাকি এবার! সাথে আবার ৩ বছর ৪ মাস আর ১ বছর ৭ মাসের দুই ‘মানব সন্তান’।

গাড়ির পিছনের তিনটে সীট ফোল্ড ক’রে ভর্তি করা হ’ল জিনিস। গাড়ির মাথায় ‘সীয়ারস্‌’ থেকে লাগানো হ’ল এক্সট্রা বাক্স। ঢাউস সাইজ।

তিন সপ্তাহে বাচ্চাদের বহু জিনিষপত্র লাগে। আমাদেরও কিছু কম লাগে না। একটু পর পর কফি আর ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা ক্যাপুচিনো নয়, দেশী চা খেতে পারলে ভালো লাগে বলে উঠলো ফ্লাক্স। লীকার ঘন করবার জন্য গুঁড়ো চা পাতা, খোশবুর জন্য ‘অরেঞ্জ পিকো লীফ’ মিশিয়ে একদম হাফ এন্ড হাফ। চা ছাকনি নিতেও ভুল হ’ল না। পথে নেমেছি বলেই কি পোড়া কপালে জুটাতে হ’বে ওই অখাদ্য ‘ডিপ ডিপ চা’? স্যান্ডউইচ, বারগার, সীজার সালাদ, ম্যাকডোনাল্ড ব্রেকফাস্ট আর ‘কে এফ সি’ চিকেন খেয়ে হাঁপিয়ে উঠতে পারি ব’লে উঠলো চাল, ডাল, লঙ্কার আচার...ওয়ালমার্ট নাকি শপকো-র নয়দিনেও ৯০ ডিগ্রী ফারেনহাইটে বরফ গলে না এমন এ্যাড দেওয়া কুলারে চেপে উঠলো মালয়েশিয়ান পরোটাও। এগুলো খুব সহজেই ভেজে ফেলা যায় - পথের মাঝখানে। সারারাত গাড়ি চালিয়ে কোন ঝর্ণার পাশে, ভোরবেলা গাড়ি থামিয়ে। উঠলো হাড়ি, কড়াই, খন্তা, স্টোভ, এমন কি রান্না করা অবস্থায় কষা মাংস আর কিমা চিকেন...আর লাল রঙা তন্দুরী মশলা  দিয়ে বারবিকিউ করা হবে বলে উঠলো তাও।

যদি পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ কোন সমুদ্রপাড়ে, গভীর জঙ্গলে কিংবা উপত্যকার কোন ফুল বিছানো মাঠে বসতে ইচ্ছে করে, তার জন্য উঠলো ফোল্ড করা পিকনিক টেবিল, চারটে চেয়ার। দুই বাচ্চার জন্য আবার রংচঙে ছোট সাইজের ফোল্ডিং লাভসীট। হাতলে তার কাপ রাখবার ব্যবস্থা। সত্যি কী পরিমাণ আরামে অভ্যস্ত হয়েছে আজ জীবন! চলতে, চলতে ঘাসের উপর, বালির উপর কিংবা সবুজ শেওলায় মোড়া, পড়ে থাকা ওই গাছের গুঁড়ির উপর বসে নিজের শরীর দিয়ে প্রকৃতি ভালোবাসবার দিন বুঝি একদমই শেষ!

এক কথায় তাঁবু ছাড়া ক্যাম্পিং গীয়ার যা ছিল আমাদের সবই গুটি গুটি চেপে বসল গাড়ীতে, জম্পেস হ’য়ে।

প্রতিবেশী ডরোথী ঘরের গাছগুলোতে জল দেবে। বাইরের গাছগুলোর জন্য বিকেলবেলা  পর্যন্ত যুদ্ধ ক’রে সেট করা হ’ল অটোমেটিক জল দেওয়ার এক সিস্টেম। আসলে সব কাজ শেষ দিনের জন্য তুলে না রাখলে হয়ত ভয় ছিল লোকে বুঝি আমাদের আর চিনবে না!

সোনালি চুল আর নীল চোখের বিদেশী প্রতিবেশী আমার ঘর দোর দেখে যাতে আৎকে না ওঠে তার জন্য যথাসম্ভব পরিষ্কার করলাম সব। পদে পদে দেশের মান সম্মান টিকিয়ে রাখবার মহান দায়িত্ব তো সব শেষে আমারই! পোষ্ট অফিসে গিয়ে ফর্ম ভরে আসা হ’ল চিঠি ‘হোল্ড’ করবার জন্য। খবরের কাগজ দিতে মানা করা হ’ল। অন্য যে গাড়ীটা কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট করে ভেঙ্গেছি তা রিপেয়ারের জন্য দিয়ে আসা হ’ল বডিশপে। এ পর্যন্ত আমি যেখানেই হাত দিয়েছি, সবকিছুই ভেঙ্গেচুরে ছত্রখান!

ফিরতে ফিরতে শীত পড়ে যাবে ব’লে ‘সুইমিং পুল’-টিও ক্লোজ করে যেতে হবে। কিন্তু কভার দিতে গিয়ে দেখি সেই কভারের ভিতর ইঁদুরের বাসা এবং প্রায় ১০-১২টি বাচ্চা ইঁদুর প্রবল প্রাণের দায়ে পুলের জলে সাঁতার কাটছে। সুতরাং, পুলের ঠান্ডা জলে নেমে একটি, একটি করে ইঁদুরছানা বাটিতে করে তুলে আলতো করে তাদের ঘাসের উপর ছাড়লাম যেন বেচারাদের কোনরকম ব্যথা না লাগে! সুযোগ পেয়ে অল্প মুচকি হাসতেও অবশ্য ভুললাম না! কোন রকম পেস্টিসাইড না দিয়ে এমন অর্গানিক বাগান করে ফেলেছি আমি ড্যানডিলাইন আগাছা আর রাজকীয় ম্যাগনোলিয়াকে একই রকম 'সযত্নে' লালন পালন করে যে এখন সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করে দিয়েছে এখানে! লনের এক হাঁটু ঘাস দেখে নগর কমিটি যেন কোনভাবেই আমাকে নোটিশ না পাঠাতে পারে, তার জন্য আমার বাগান নামক প্রাণের জঙ্গলের জন্য সাইনবোর্ড রেডী করে রেখেছি। 'প্রেইরী রিজার্ভ।' এ আমেরিকায় সব চ'লে। শুধু কায়দাটি জানা চাই।

যাহোক এইভাবে কোনমতে আমার বিশ্বটি তালি টালি মেরে সামলিয়ে ফেললাম।  শুধু সামান্য সমস্যা।প্রস্তুতিপর্বে এত দেরী হ’ল যে সন্ধ্যা ছ’টার জায়গায় অবশেষে রাত আড়াইটার সময় উটের পিঠেও নয়, ক্যারাভানেও নয়, স্রেফ গাড়ীতে চেপেই লম্বা সফরে বের হ’য়ে পড়লাম আমরা। পথ উইস্কনসিন থেকে মিনেসোটা, সাউথ ডাকোটা, উমিঙ, মণ্টানা, আইডাহো, ওরেগন, ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা, নেভাডা, উটাহ, কলোরাডো, নেবরাস্‌কা, আইওয়া হ’য়ে আবার ঘরে – উইস্কনসিনে।